1. info@www.dailybdcrimetimes.com : দৈনিক বিডি ক্রাইম টাইমস.কম :
সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:২৭ পূর্বাহ্ন
Title :
প্রেমের ফাঁদে ফেলে মিথ্যা ধর্ষন মামলার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন বাউফলে ভাঙাচুরা রাস্তাঘাট দ্রুত সংস্কারের দাবিতে মানববন্ধন বাউফলে দু’গ্রুপের সংঘর্ষ, সেনা সদস্য সহ আহত- ১৪ নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে চাকরিচ্যুত হলেন আনন্দ টিভির ডেপুটি নিউজ এডিটর হারানো বিজ্ঞপ্তি ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নীলফামারী জেলা মানবাধিকার সংস্থা (আসক) ফাউন্ডেশন এর উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত বরগুনার বামনায় যুবদল নেতার চেক জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাৎ: সিসিটিভি শনাক্ততে কট রংপুরে হোটেল থেকে ধরে জুয়ার মামলায় চালান দেয়ার অভিযোগ উঠেছে ওসির বিরুদ্ধে সাংবাদিক কে হুমকির প্রতিবাদে বাউফলে কর্মরত সাংবাদিকদের মানববন্ধন ও প্রতিবাদ ইসরাইলের মিশন, পরিকল্পনা, সাফল্য ও সম্ভাবনা

ইসরাইলের মিশন, পরিকল্পনা, সাফল্য ও সম্ভাবনা

Reporter Name
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২৫
  • ৪৮ Time View

তারিকুল আমিন:

সেই প্রাচীনকালের কথা। তখন ইসরায়েলিরা পরিচিত ছিল ‘হিব্রু জাতি’ হিসেবে। তাদের আদি পুরুষ ছিলেন ইব্রাহিম (আ:)। ইহুদীরা প্রথম থেকেই যাযাবরের মতো ঘুরেছে সর্বত্র। তারা ঘুরতে ঘুরতে আব্রাহাম বা ইব্রাহিম নবী এক সময় কেনান (ইসরায়েল বা ফিলিস্তিন) অঞ্চলে এসে তারা বসতি গড়ে তোলেন। ইব্রাহিম (আ:) এর দুই পুত্র সন্তান ইসমাইল ও ইসহাক। ইসমাইলকে মায়ের সাথে মক্কায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। কেনানে থেকে যায় ইসহাক। ইসহাকের ছেলে ইয়াকুব বা জ্যাকোবের আরেক নাম ছিল ইসরাইল। অনেকের মতে তার নামেই নাম রাখা হয়। তাদের বংশধরেরাই বনী ইসরাইল নামে পরিচিত। ইয়াকুবের ১২ সন্তানের মাধ্যমে বনী ইসরাইলে ১২ গোত্রের সৃষ্টি হয়েছিলেন বলেই সবাই বিশ্বাস করেন। তার একমাত্র সন্তান ইউসুফ সেই সময় মিশরের ক্ষমতার উচ্চপদে বসেছিলেন, তিনি বনী ইসরাইলের পুরো বংশকে মিশরে নিয়ে আসেন। সময়ের পরিক্রমায় ইহুদীরা মিশরে ফেরাউনের (রেমেসিস) দাস হতে বাধ্য হয়েছিলেন। কয়েকশ বছর পর মুসা নবী ইহুদীদের উদ্ধার করে অলৌকিকভাবে লোহিত সাগর পার করে নিয়ে আসেন কেনান শহরে।
প্রতিটা জাতির যেমন উত্থান রয়েছে তেমনি পতনের ইতিহাসও কম নয়। ‘হিব্রু জাতি’র সাম্রাজ্যের উত্থান হয়েছে ডেভিড বা দাউদ (আ:) এর হাত ধরে। সেটা প্রায় ১০০০ খ্রি. পূর্বের ঘটনা। তিনি ছিলেন একজন সামান্য মেষপালক। বাইবেলে আছে এক যুদ্ধে গলিয়াদ নামের বিশাল এক যোদ্ধাকে পাথর ছুঁড়ে পরাজিত করেছিলেন মেষবালক ডেভিড। পরবর্তীতে ডেভিড ইসরাইলের সবচেয়ে বড় যোদ্ধা হয়ে ওঠেন। ইসরাইলকে এক বিশাল সাম্রাজে পরিণত করেন তিনি। দাউদ (আ:) এর জনপ্রিয়তায় ঈর্শান্বিত হয়ে একদিন তাকে খুনের চেষ্টা করেন রাজা সাউল। সাউল বা তালুত ছিলেন ইসরাইলের প্রথম রাজা। ১০২৪ খ্রি. পূর্বাব্দে তিনি রাজা হয়েছিলেন। সাউলের উপর অভিমান করে শেষ পর্যন্ত ইসরাইল থেকে চলে যান দাউদ (আ:)।
স্থানীয় ফিলিস্তিনরা ছিলেন পৌত্তলিক ধর্মে বিশ্বাসী। আর ইহুদীরা ছিলেন এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী। ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরায়েলের ছিল চির বৈরিতা। দাউদ (আ:) না থাকায় ফিলিস্তিনিদের কাছে এবার পরাজিত হন সাউল। যুদ্ধে মারা যায় সাউল এর একমাত্র পুত্র। পুত্র সন্তানের শোকে যুদ্ধের মাঠেই তিনি আত্মহত্যা করেন। নির্বাসনে থাকা অবস্থায় দাউদ (আ:) এবার রাজা হন ইসরায়েল রাজ্যের। এবার ডেভিড তার জনগনের জন্য নতুন শহর দখল করতে থাকেন। খুব সহজেই জেরুজালেম দখল করে নেয় ডেভিড ও তার বাহিনী। তারপর থেকেই ‘জেরুজালেম’ পবিত্র ভূমি হয়ে ওঠে ইহুদীদের কাছে। এই শহরটি ‘ডেভিডের শহর’ নামেও পরিচিত হয়ে উঠে। দীর্ঘদিন শাসন করার পর ডেভিড ধীরে ধীরে বৃদ্ধ হন। পরে তার ছেলে সুলোমন বা সুলায়মান (আ:) কে ইসরাইলের রাজা বানিয়ে নিজে ছুটি নেন। ৯৭০ খ্রি.পূর্বাব্দে মারা যান ডেভিড বা দাউদ (আ:)। এরপর ইসরাইলে শুরু হয় সুলেমানের যুগ। যাকে বলা হয় ইহুদীদের স্বর্ণযুগ। জেরুজালেমে তিনি ‘প্রথম টেম্পল’ বা ‘টেম্পল অফ সলোমন’ নির্মাণ করেন। ইতিহাস বলে এটি জেরুজালেমের নির্মিত ‘প্রথম উপাসানালয়’। ইসলামে যা ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ নামে পরিচিত।
কেনান বা আজকে যাকে ইসরায়েল বা ফিলিস্তিন বলা হয়। এই কেনানেই সূচনা হয়, আবার পতনও হয় এই কেনান শহরেই। বিশাল এক সাম্রাজ্য রেখে ৯৩০ খ্রি. পূর্বে মারা যান সুলেমান (আ:)। তার মৃত্যুর পর জেরুজালেম চলে যায় মিশরীয়দের দখলে। ইহুদীরা বিতাড়িত হতে থাকে জেরুজালেম থেকে। সুলেমানের মৃত্যুর পর পতন শুরু হতে থাকে ইসরাইলের। একটি জাতি বা একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যোগ্য আর যোগ্য পথপ্রর্দশক না থাকলে রাষ্ট্রের ভিত ভেঙ্গে পড়ে। তেমনটিই হয়েছিল ইহুদীদের বেলা। ৫১৬ খ্রি. পূর্বে রাজা হেরড সেখানে ‘দ্বিতীয় টেম্পল’ তৈরি করেন। টেম্পলের চারপাশ দিয়ে প্রাচীর দ্বারা আবদ্ধ করে দেন। এই প্রাচীরই ইহুদীদের ‘কেবলা’ বা মুসলমানদের ‘বুরাক দেয়াল’ নামে পরিচিত। ৫৮৫ বছর এটা টিকে ছিল। কিন্তু রোমানরা এটি ধ্বংস করে ৭০ সালে। আলেকজান্ডারও দখল করেছিল এই ভূখণ্ড। গাজায় আলেকজান্ডারের বাহিনীর সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়েছিল। গাজায় অনেক মানুষ হত্যা করেছিল আলেকজান্ডার। যীশু খ্রিষ্টের জন্মের সময় এই অঞ্চল দখলে ছিল রোমানদের। ৭০ খ্রি. রোমানরা এসে জেরুজালেম শহর ধ্বংস করে দেয়। ইসরায়েল নামের আর কোন ভুখন্ড থাকে না।
রোমানরা যখন ‘হেরোদ দ্যা গ্রেট’কে জুদাহ রাজ্যের রাজা বানান, তখন ইহুদী অঞ্চল বেথেলহেমে জন্ম নেন খ্রিস্ট ধর্মের প্রধান পুরুষ যীশু বা ঈসা নবী। যীশুকে ক্রুশ বিদ্ধ করার পিছনে ইহুদীদের ষড়যন্ত্র ছিল বলে খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করে। তাই ইহুদীদের সব সময় সন্দেহের চোখে দেখত খ্রিষ্টানরা। এরপর রোমানদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্ম যত জনপ্রিয় হতে থাকে ততই ইহুদী বিদ্বেষ বাড়তে থাকে। ৬৪ সালে নিজেদের সুরক্ষার জন্য একটি আইন জারি করে ইহুদিরা। তাতে ৬ বছরের বেশি বয়সী সকল ইহুদীদের পড়াশোনা বাধ্যতামূলক করা হয়। এরপর থেকেই ইহুদীরা শিক্ষাকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে। ৬৬ সালে রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে ইহুদীরা। এর চরম মূল্য দিতে হয় তাদের। ১০ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করা হয় এবং রোমানরা জেরুজালেম থেকে তাদের বিতাড়িত করে। এরপর ইহুদী ধর্মই নিষিদ্ধ করে সম্রাট হাদ্রিয়ান ১৩১ সালে। জেরুজালেমের নাম পাল্টিয়ে রাখা হয় ‘ইলিয়া কাপাতোলিনা’। আর ইহুদি প্রদেশের নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘ফিলিস্তিন’ বা ‘প্যালেস্টাইন’। সম্রাট কন্সট্যান্টিয়ান রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে খ্রিষ্ট ধর্ম চালু করেন ৩১২ সালে। এরপর ইহুদীদের সংকট আরো বাড়তে থাকে। আরো তিনশ বছর ইহুদীরা জেরুজালেম থেকে বিতারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা বিশ্বময়। দ্বিতীয় খলিফা উমরের সময় মুসলমানেরা জেরুজালেম জয় করে ৬৩৭ সালে। খলিফা উমর নিজে গিয়েছিলেন জেরুজালেম শহরের চাবি গ্রহণ করতে। ৬৯১ সালে আজকের সেই বিখ্যাত সোনালী গম্বুজ নির্মাণ করেন খলিফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানী। আর মসজিদুল আকসা নির্মাণ হয় ৭০৫ সালে। ১০৯৯ সালে খ্রিস্টানদের দখলের আগে জেরুজালেম মুসলমানদের অধীনেই ছিল।
প্রায় ৮৮ বছর পর ১১৮৭ সালে খ্রিস্টানদের কাছ থেকে আবারও জেরুজালেম জয় করেন সালাহুদ্দিন আইয়বি। অটোমান সম্রাট সুলতান সুলেমান ১৫৩৮ সালে জেরুজালেমকে ঘিরে বিখ্যাত দেয়াল তুলেন। যেটি এখন ‘ওয়াল’ বা ‘জেরুজালেম’ নামে পরিচিত। এর চারপাশে এখনও ইহুদী, খ্রিষ্টান, মুসলমান ও আর্মেনিয়ানরা বাস করে। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত জেরুজালেম অটোমানদের দখলেই থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরুস্ক হেরে যাওয়ার পর ব্রিটেন ও ফান্স নিয়ন্ত্রণে নেয়। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ইহুদীদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরির পথ প্রশস্ত করে ব্রিটেন। ব্যারন রথচাইল্ড ছিলেন সে সময়ের একজন ডাকসাইটে ব্রিটিশ ইহুদী নেতা। তাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেমস বেলফোর। সেই চিঠিতেই প্রথম ইহুদী রাষ্ট্র গঠনে তাদের সম্মতির কথা জানায় ব্রিটেন। পাঁচ দিন পর চিঠিটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেলে ইহুদী রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি হিসেবে ‘বেলফোর ঘোষণা’ সারাবিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
এই ঘোষণার পর দলে দলে ইহুদীদের ফিলিস্তিন ভুখন্ডে যাওয়া বাড়তে থাকে। এর আগে ১৯০২ সালে ইহুদিদের ৩৫ হাজারের একটি দল ফিলিস্তিনে পৌঁছায়। যাকে বলা যায় ইহুদিদের প্রথম আলিয়া। ‘আলিয়া’ মানে হল ইহুদীদের পুণর্বাসন। এরপর ১৯১৪ সালে ৪০ হাজার। ১৯২৮ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮২ হাজারে। ফিলিস্তিনের কিটবুস অঞ্চলে তারা এসে প্রথমে বসতি গড়ে। গাজা থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরত্বে কিটবুস। সেখানে প্রাচীনকাল থেকে কিছু ইহুদি স্থানীয় আরবদের সাথে বাস করতো। এসেই তারা কৃষিকাজের সাথে যুক্ত হয়। জমি কিনে বসতি গড়তে থাকে। প্রথমে স্থানীয় আরবরা তাদের স্বাগত জানিয়েছিল। তারা বুঝতে পারেনি এই জায়গা দেয়াই তাদেরই একদিন কাল হবে, উচ্ছেদ হয়ে যেতে হবে নিজেদের ভুখন্ড থেকে। এটাই ছিল ফিলিস্তিনিদের প্রথম ভুল। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি গভীর সংকটের দিকে যেতে থাকে। ১৯০২ সালে ফিলিস্তিনে ছিল মাত্র কয়েক হাজার ইহুদি। ১৯৩১ সালে সেই সংখ্যা যায় ১ লাখ ৮০ হাজার। স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করে। খ্রিস্টধর্ম যখন জনপ্রিয় হচ্ছিল তখনও বাজারে প্রচলিত ছিল “ইহুদীরাই যীশু খ্রিস্টকে শুরে চড়াতে সাহায্য করেছে”, “ইহুদিরা তাদের রিচুয়ালে ছোট ছোট খ্রিস্টান বাচ্চাদের রক্ত পান করে”, “ইহুদিরা তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে খ্রিস্টান বাচ্চাদের বলি দেয়”। এরকম গুজবের ফল ছিল ব্যাপক হারে ইহুদি নিধন। ক্রুসেডের সময়ও দেখা যায় যেখানে প্রচুর ইহুদিদের হত্যা করা হয়েছে। এটা শুধু সেই আমলে না। শত বছর আগেও যখন ইহুদিদের নির্দিষ্ট কোন দেশ ছিল না, যখন তারা পুরো ইউরোপ অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করত তখনো বলা হত সমাজের সকল অব্যবস্থার পিছনে দায়ী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই জার্মানীসহ পুরো ইউরোপে ইহুদী বিদ্বেষ শুরু হয়। হিটলার ৬০ লাখ ইহুদীকে হত্যা করে। ইতিহাসে যা ‘হলোকস্ট’ নামে পরিচিত। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লাখ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেঁচে যাওয়া ১ লাখ ইহুদীকে যখন ফিলিস্তিনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা তখন পরিস্থিতি নতুন দিকে মোড় নেয়। ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্রিটেন। আজ তারাই বিরোধীতা করতে শুরু করে। ব্রিটেনের মতে এই বিশাল সংখ্যক ইহুদি সেখানে গেলে, স্থানীয় আরবদের মধ্যে সংঘর্ষের মাত্রা বেড়ে যাবে। যা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এমন কথায় ইসরায়েলিরা এক সময়ের মিত্র ব্রিটেনকে শক্র মনে করতে শুরু করে। এবার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে ইহুদীরা। আরব আর ব্রিটিশ দুপক্ষের বিরুদ্ধে একসাথে যুদ্ধ করতে থাকে রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর ইহুদীরা। ব্রিটেন শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বিষয়টি নিয়ে যায় জাতিসংঘে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে জাতিসংঘ একটি নতুন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় ফিলিস্তিনিদের উপর। ফিলিস্তিন ভুখন্ড ভাগ হয় তিন ভাগে। ৫৬.৫ শতাংশ নিয়ে গঠিত হয় ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল আর ৪৩.৫ শতাংশ নিয়ে হয় আরব রাষ্ট্র ফিলিস্তিন। পবিত্র শহর জেরুজালেমকে রাখা হয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে। ফিলিস্তিনিরা সাথে সাথে এ অন্যায় সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখান করে। অন্যদিকে এই সিদ্ধান্তে উল্লাসে ফেটে পড়ে জায়ানবাদিরা। দীর্ঘদিনের কাঙ্খিত একটি দেশের স্বপ্ন পূরণ হয় ইহুদীদের। স্বপ্নের সেই দেশের নাম রাখা হয় ‘ইসরায়েল’। ১৯৪৮ সালে জায়ানবাদী আন্দোলনের ফলে ইহুদীদের একটি রাষ্ট্রের ব্যবস্থা করে পশ্চিমারা।
ইসরাইলের মিশন ছিল তৃণমূল পর্যায়ে নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল একসেস, তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ মানবসম্পদ উন্নয়ন, আইটিশিল্পের রপ্তানীমুখী বিকাশ এবং জনবান্ধব তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। যেখানে ইহুদী জাতি ছাড়া অন্য কোন জাতি থাকতে পারবে না। ইসরায়েলে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশন বলতে ইসরায়েলের বৈদেশিক দূতাবাস এবং কনস্যুলেটদের বোঝানো হয়। ইসরায়েলে বর্তমানে ৮৬ টি দূতাবাস রয়েছে, যার সবগুলো তেল আবিব এবং তেল আবিব মেট্রোপলিটন এলাকায় অবস্থিত। এছাড়াও, কিছু দেশ অন্য শহরগুলোতে কনস্যুলেট পরিচালনা করে থাকে, এদের মধ্যে রয়েছে- ইলাত, হাইফা বা জেরুসালেম। পূর্বে, কিছু দেশ জেরুসালেমে তাদের দূতাবাস পরিচালনা করলেও বর্তমানে সেগুলো তেল আবিবে স্থানান্তর করা হয়েছে, যা বিগত ১৯৮২-উত্তর সময় থেকে শুরু হয়ে ২০০৬ সালে কোস্টা রিকা ও এল সালভাদোর স্থানান্তর করে। ৬ ডিসেম্বর ২০১৭- তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে ইসরায়েলে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসকে সরিয়ে জেরুসালেম নিয়ে যাওয়া হবে। ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ এই স্থানান্তর সংগঠিত হতে পারে।
পরিকল্পনা
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা নিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে ইসরাইল। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যবস্থাপনার প্রথম ও প্রধান কাজ হলো পরিকল্পনা। এটি হলো ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজের ভিত্তি। ভবিষ্যতে আমরা কী চাই, কখন ও কিভাবে চাই ইত্যাদি বিষয়গুলো পূর্বে নির্ধারণ করাকেই পরিকল্পনা বলে। আঠারো শতকের শেষের দিকে জায়ানিজম বা ইহুদীবাদ ধারণা গড়ে উঠতে শুরু করে ইউরোপে। সেটা মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনের ভুখন্ডকে ভাগ করে। জন্ম হয় ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল। ইউরোপ ও রাশিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদীদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা একমাত্র লক্ষ্য। তাদের বিশ্বাস ইহুদীদের পরিত্রাতা ‘মসীহ’ ফিরে আসবেন ফিলিস্তিনের পবিত্র শহর জেরুজালেমে। তাই ইহুদিদের কাঙ্খিত রাষ্ট্রের যোগ্যতম স্থান হলো ফিলিস্তিন। একটি স্লোগান সেসময় খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ইউরোপে ‘মানুষ বিহীন দেশটি হবে, দেশহীন মানুষদের জন্য’। জায়ানবাদিরা প্রচার করছিল ফিলিস্তিনের জনমানব শূন্য জায়গায় তারা ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। তাদের এই প্রচারণা সঠিক ছিল না। শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক কুটচালে ফিলিস্তিন ভুখন্ডে ইহুদী রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন পূরণ হয় ইহুদীদের। আর ধ্বংস হয়ে যায় স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন। ইহুদীদের সেই ধর্ম বিশ্বাসকে পাশ কাটিয়ে জায়ানবাদিরা একটি স্বতন্ত্র ইহুদী রাষ্ট্র তৈরির আন্দোলন বেশ জনপ্রিয় করে তোলে ইউরোপ আমেরিকায়। ১৮৯৭ সালে থিওডোর হার্সেল নামে এক ইহুদি ‘ওয়াল্ড জায়ানিষ্ট অর্গানাজেশন’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তারা প্রথমে ধারণা করেছিলেন ইউরোপের কোথাও ইহুদীদের জন্য একটি ছোট রাষ্ট্র হবে। কিন্তু সে সময় এন্ট্রি সেমিটিজম বা ইহুদী বিদ্বেষ গোটা ইউরোপ জুড়ে এত প্রবল ছিল যে, সেই সম্ভাবনা পুরোপুরি নাকচ হয়ে যায়। হার্সেল এই সময় আন্দোলনকে আরো জোরদার করে তোলে। জায়ানবাদিরা মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন ভুখন্ডে তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে থাকে। কারণ তারা ফিলিস্তিনকে তাদের আদি ভুখন্ড মনে করে।
তেমনি ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডের নিচে থাকা হামাসের সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক সমুদ্রের পানিতে প্লাবিত করার কথা বিবেচনা করেছে ইসরাইল। এ লক্ষ্যে বড় সিস্টেমের পাম্পও একত্রিত করেছে। মূলত সুড়ঙ্গে অবস্থান করা হামাস যোদ্ধাদের বের করে দিতে টানেলগুলোকে প্লাবিত করার কথা ভাবছে তারা। এ খবর জানিয়েছে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’। ইহুদিবাদী ইসরাইলের নয়া বসতি নির্মাণ পরিকল্পনা করেছে। সম্প্রতি তেল আবিব জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে নতুন করে ২,৫০০ ইহুদি বসতি নির্মাণ পরিকল্পনার ঘোষণা করেছে।
যুদ্ধের ডাক দিয়ে হামাসের বিরুদ্ধে তিন ধাপে যুদ্ধ পরিকল্পনাও করা হয়েছে। ইসরাইলের উদ্দেশ্য- হামাসকে ধ্বংস করে গাজায় একটি ‘নতুন নিরাপত্তা শাসনব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করা। গাজা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানিয়েছে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত। তিনি জানান, গাজায় হামাসের সরকারব্যবস্থা ও সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করতে তিন ধাপে যুদ্ধ চালানো হবে। এর মধ্য দিয়ে হামাসকে নির্মূল করা হবে। তিনি বলেন, এখন যুদ্ধের প্রথম ধাপ চলছে। এ ধাপে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে হামাসকে নিরস্ত্রীকরণ ও তাদের অবকাঠামোকে ধ্বংস করা হবে। এতে তারা বসতিতে বসবাস করবে তা না হলে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হবে। ইসরাইলি পার্লামেন্ট নেসেটের (কহবংংবঃ) পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কমিটির সামনে গ্যালান্ত জানান, পরবর্তী ধাপগুলো কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসে শেষ হয়ে যাবে- এমনটা ভাবা যাবে না। তবে এ তিন ধাপের যুদ্ধের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো- ‘এই অঞ্চলে (গাজায়) একটি নতুন ‘নিরাপত্তা শাসনব্যবস্থা’ গঠন করে গাজার ওপর ইসরাইলের দায়বদ্ধতা শেষ করা।’ গ্যালান্ত আরও বলেন, ‘গাজায় সামরিক অভিযান ইসরাইলের নাগরিকদের জন্য একটি নতুন নিরাপত্তা বাস্তবতা প্রতিস্থাপন করবে।’
গাজায় ইসরাইল জাতিগত নির্মূল করার পরিকল্পনা করেন। এমনকি এ বিষয়ে আংশিক ইঙ্গিত দিয়েছে ইসরাইলি আউটলেট ক্যালক্যালিস্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন। জাতিগত নির্মূল পরিকল্পনার রূপরেখা নিয়ে তৈরি ইসরাইলের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ের (মিনিস্ট্রি অব ইন্টিলিজেন্স) ফাঁস হওয়া একটি নীতির খসড়া নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই যে ইসরাইল জাতিগত নির্মূল করার পরিকল্পনা করেন। ‘স্ট্র্যাটেজিজ অব প্যালেস্টানিয়ান উইমেন ইন ইসরাইল’ নামের বইতে বলেন, ফিলিস্তিনি নারীদের জরায়ুকে হুমকি হিসেবে প্রচার করে ইসরাইল। জায়নিস্ট রাষ্ট্রবাসনা আর সব জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। ফিলিস্তিনিদের জন্মরুখতে চায়। ২০১৪ সালে ইসরাইলি আইনপ্রণেতা এয়িলেট শ্যাকেড পুরো ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে শত্রু ঘোষণা দিয়ে নারী হত্যার করতে বলেন। তিনি বলেন, “ওই নারীদের হত্যা করতে হবে, কেননা তারা সাপের বাচ্চা’র জন্ম দেয়।”
বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্কুলগুলোতে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনি শিশুদের শিক্ষিত হতে না দেওয়া। এবং হসপিটালে ওরা জাতে শিশু সন্তান জন্মদিতে না পারে। তাই আমরা দেখতে পাই ১০ মে হামাস ইসরায়েলকে টেম্পল মাউন্ট কমপ্লেক্স ও শেখ জাররাহ থেকে নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহারের আল্টিমেটাম দেয়। একই দিনে হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামি জিহাদ গাজা ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপ শুরু করে, যেগুলো একাধিক বাসভবন ও একটি স্কুলে আঘাত হানে। পরবর্তীতে ইসরায়েল গাজার অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালায়। ফলে ১৬ মে নাগাদ প্রায় ৯৫০টি হামলায় চারটি উঁচু টাওয়ারসহ ১৮টি ভবন, ৪০টি বিদ্যালয় ও চারটি হাসপাতাল সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। আল-শাতি শরণার্থী শিবিরেও হামলা চালানো হয়। এছাড়াও ইসরায়েলি বোমা হামলায় কমপক্ষে ১৯টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়। এই সহিংসতার ফলে গাজায় ৬৬ জন শিশুসহ কমপক্ষে ২৪৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। এবং ফিলিস্তিনি রকেট হামলায় ইসরায়েলে একজন শিশুসহ মোট ১২ জন নিহত হন। ২১ মে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাতকে বিক্ষোভ, পুলিশের বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ, হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামি জিহাদ কর্তৃক ইসরায়েলে রকেট হামলা এবং গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বিমান হামলা ইত্যাদি এসব পরিকল্পিত হামলা।
পরিকল্পনামত তারা মসজিদগুলোতে হামলা করে। নামাযরত মোসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলা তাদের উদ্দেশ্য। ৭ মে ইসরায়েলি পুলিশ ইহুদি ধর্মের পবিত্রতম স্থান টেম্পল মাউন্টে অবস্থিত ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে হামলা চালায়। পুলিশ পাথর নিক্ষেপকারী ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট এবং স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করে। ইহুদি জাতীয়তাবাদীদের পরিকল্পিত মিছিলের আগে (মিছিল পরে বাতিল করা হয়) এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় ৩০০ জনেরও বেশি লোক আহত হন, যাদের বেশিরভাগই ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক। ১১ মে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী জানায় ফিলিস্তিনি হতাহতের মধ্যে অন্তত ১৫ জন হামাসের সদস্য এবং গাজা ভূখণ্ডে ভুল রকেট উৎক্ষেপণের ফলে কিছু ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। ২০২১ সালের ১৯ মে অনুযায়ী, এই সংঘাতে কমপক্ষে ৭২,০০০ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়। এবং ২০ মে ফিলিস্তিন জাতীয় কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কমপক্ষে ১,৯০০ ফিলিস্তিনি নাগরিক আহত হন। ১৩ মে হামাস প্রথম যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তা প্রত্যাখ্যান করেন।
ইসরায়েলি টেলিযোগাযোগ সংস্থা সেলকম এই সহাবস্থানের সমর্থনে এক ঘন্টার জন্য কাজ বন্ধ করে দেয়। ১৩ মে, হামাস ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে আত্মঘাতী ড্রোন মোতায়েনের চেষ্টা করে। আয়রন ডোম ইসরায়েলের দিকে নিক্ষেপ করা অনেকগুলো রকেট রুদ্ধ করে। হামাসের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীর সদর দপ্তর, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও হামাসের একজন জ্যেষ্ঠ কমান্ডারের বাড়ি লক্ষ্য করে ইসরায়েল বেশ কয়েকবার হামলা চালায়। ইসরায়েলি স্থলবাহিনী সীমান্তে অবস্থান করে গাজায় আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। একই দিনে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী হামাসের বিস্তৃত ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গে ব্যাপক বোমাবর্ষণ শুরু করে। সন্দেহ করা হয়, ইসরায়েলি স্থল আক্রমণের খবর হামাস যোদ্ধাদের সুড়ঙ্গে প্রলুব্ধ করার জন্য আইডিএফ ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করে যাতে বিমান হামলায় বিপুল সংখ্যক যোদ্ধা নিহত হয়। একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তার মতে, এই বোমাবর্ষণে হামাসের শতাধিক সেনা ও ২০ জন কমান্ডার নিহত হন। কিন্তু আনুমানিক মৃতের সংখ্যা কয়েক ডজনে নেমে আসে যখন জানা যায়, হামাসের জ্যেষ্ঠ কমান্ডাররা আই.ডি.এফ-এর এই কৌশল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং বোমা হামলার পূর্বে মাত্র কয়েক ডজন হামাস যোদ্ধা সুড়ঙ্গে অবস্থান নেয়। ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর মোট ১৬০টি বিমান ১৫০টি লক্ষ্য বস্তুতে ৪৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
ইসরাইলের অন্যতম পরিকল্পনা হল ফিলিস্তিনিদের সংবাদ বা প্রেস মাধ্যমকে ধ্বংস করা। তাই তারা ১৫ মে, ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী গাজার আল-জালা ভবনে হামলা চালায়, যেখানে আল জাজিরা ও অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সাংবাদিকদের বাসস্থান ও আরও বেশ কয়েকটি অফিস ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে। আইডিএফ কর্তৃক হামাসের সুড়ঙ্গে হামলার পরিকল্পনার অ্যানিমেশন ১৭ মে, ইসরায়েলি বিমানবাহিনী হামাসের সুড়ঙ্গে আরেকটি বড় অভিযান চালায়; ১৫ কিলোমিটারেরও বেশি ভূগর্ভস্থ প্যাসেজে বোমাবর্ষণ করে, ৫৪টি ইসরায়েলি জেট বিমান ১১০টি বোমা ফেলে। ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর একটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান গাজা ভূখণ্ডে আক্রমণ চালাতে যুদ্ধোপকরণসহ যাত্রা করছে এই সংঘাত চলাকালীন, দক্ষিণ ও মধ্য ইসরায়েলে প্রতিদিন গড়ে ৪০০টি করে মোট ৪,৩৬০ টিরও বেশি রকেট ও মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়। প্রায় ৩,৪০০টি রকেট সফলভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে এবং ৬৮০টি গাজায় ও ২৮০টি সমুদ্রে পতিত হয়। আয়রন ডোম ১,৪২৮টি রকেট ধ্বংস করে যেগুলো জনবহুল এলাকার দিকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো। আয়রন ডোম প্রায় ৬০-৭০টি রকেট আটকাতে ব্যর্থ হওয়ায় এগুলো জনবহুল এলাকায় আঘাত হানে।
সাফল্য
ইসরায়েলের রাজনীতি একটি সংসদীয় প্রতিনিধিত্বমূলক বহুদলীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কাঠামোয় সংঘটিত হয়। রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রের প্রধান। সরকার প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা তার উপর ন্যস্ত। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা নেসেট (কহবংংবঃ) নামের আইনসভার উপর ন্যস্ত। বিচার বিভাগ নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন বিভাগ থেকে স্বাধীন। পররাষ্ট্র নীতিতে ইসরায়েলের সঙ্গে ১৭০টি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। তবে তারা কিছুটা সফল হতে ব্যর্থ আমি বলবো। কারণ ফিলিস্তিন বিবাদের জন্য মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে শীতল সম্পর্ক রয়েছে তাদের।
ইসরায়েলের প্রশাসনিক অঞ্চল ছয়টি জেলা নিয়ে। এগুলো হচ্ছে জেরুসালেম জেলা, উত্তর জেলা, হায়ফা জেলা, মধ্য জেলা, তেল আবিব জেলা, দক্ষিণ জেলা এবং জুডিয়া এ্যান্ড সামারিয়া এলাকা। ইসরায়েলের সশস্ত্র বা সামরিক বাহিনী (ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস, সংক্ষেপে আইডিএফ) তিনটি মিলিটারি সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত। সংস্থাগুলো হচ্ছে- স্থলবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনী। তিন বাহিনীকে এক বাহিনী ধরা হয়; এই বাহিনী দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। অফিসিয়ালি ইসরায়েল সশস্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৪৮ সালের ২৬ মে কেবিনেটের সিদ্ধান্তক্রমে। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় বাধ্যতামূলকভাবে অনেক ইহুদিকে এই বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়। এ ছাড়াও ইহুদিদের তিনটি সংগঠন হাগানাহ, ইরগান ও লেহির সদস্যদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে এই বাহিনী গঠন করা হয়। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠা আর নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অনেকগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয় এই বাহিনীকে। বিভিন্ন দেশের সাথে এই বাহিনীর অস্ত্র ও প্রযুক্তির বেশ পার্থক্য রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মারকাভা মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক, উজি সাব মেশিনগান এবং গালিল ও টাভর অ্যাসল্ট রাইফেল। আইডিএফ’র উন্নয়নে বিভিন্ন খাতে অর্থ সহযোগিতা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খাত হচ্ছে এফ-১৫১ জেট বিমান, টিএইচ। ইসরায়েলি বিমান বাহিনীতে রয়েছে লকহিড মার্টিন এফ-৩৫ লাইটনিং দ্বিতীয়, এফ-১৬ ফাইটনিং ফ্যালকন, ম্যাকডনেল ডগলাস এফ-১৫ ই স্ট্রাইক ইগল, এফ-১৫ ঈগল। ইসরায়েল পশ্চিম এশিয়াতে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। এই ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল ধরে সমভূমি অবস্থিত। ইসরায়েলের দক্ষিণে রয়েছে বিশাল নেগেভ মরুভূমি আর উত্তরে আছে বরফাবৃত পর্বতমালা। দক্ষিণে লোহিত সাগরে এক চিলতে প্রবেশপথ আছে।
ইসরায়েলের অর্থনীতি আধুনিক পশ্চিমা অর্থনীতির সমপর্যায়ের। ইসরায়েলের নিজস্ব সম্পদের পরিমাণ খুব কম। দেশটি ১৯৭০-এর দশক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক অনুদান পেয়ে আসছে, তবে ১৯৯৮- এরপর এই অনুদানের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়। ইসরায়েল ও. ই. সি. ডি. (‘অরগ্যানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো – অপারেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট’ ) এর সদস্য। দেশটির মানুষের জীবনযাত্রার মান খুবই উন্নত এবং ২০১২ সাল অনুযায়ী দেশটির মাথাপিছু আয় ৩৫,০০০ মার্কিন ডলার। ইসরায়েলের উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সরকারের ভালো সদিচ্ছা থাকার কারণে দেশটিতে বেকারত্ব খুবই কম। ইসরায়েলের জনসংখ্যা প্রায় ৯ মিলিয়ন।
ইসরায়েল ভাষা ও সংস্কৃতিগত দিক থেকে একদম বিচিত্র। এথনোলগের ১৫শ সংস্করণ অনুসারে ইসরায়েলে ৩৩টির মত ছোট-বড় ভাষা ও উপভাষা প্রচলিত রয়েছে। ইসরায়েলি নাগরিকেরা নিজেদের মধ্যে ভাব আদান প্রদানের জন্য মূলত আধুনিক হিব্রু ভাষা ব্যবহার করেন। আধুনিক হিব্রু ভাষাটি ১৯শ শতকের শেষ দিকে প্রাচীন হিব্রু ভাষার বিভিন্ন উপভাষার উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছিল এবং এতে ও জার্মানিয় ভাষা সমূহের কিছু প্রভাব আছে। ভাষার সরকারি মর্যাদা ও ভাষা সংক্রান্ত নীতিমালার উপর ইসরায়েলে বেশ কিছু আইন আছে। বর্তমানে হিব্রু ও আরবি ইসরায়েলের সরকারি ভাষা। ইসরায়েলের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি তার জনসংখ্যার বৈচিত্র্য থেকে উদ্ভূত। বিশ্বব্যাপী প্রবাসী সম্প্রদায়ের ইহুদিরা তাদের সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যকে তাদের সাথে ফিরিয়ে এনেছিল। স্থাপত্য, সঙ্গীত এবং রান্নার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আরবের প্রভাব বিদ্যমান আছে। একটি মজার বিষয় হচ্ছে ইজরায়েলই বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে হিব্রু ক্যালেন্ডারের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। কর্মক্ষেত্র ও স্কুল ছুটি ইহুদি ছুটির দ্বারা নির্ধারিত হয় এবং শনিবার তাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন।
ইসরায়েলের পর্যটন মূলত ইহুদী, ইসলাম ধর্মের পবিত্র ও ঐতিহাসিক স্থানগুলিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। দেশটির সর্বত্র ইহুদী ধর্মের ও সভ্যতার স্মৃতিবিজড়িত নানা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ইহুদীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় শহর এবং মুসলিম ও খ্রিস্টানদেরও গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান হল জেরুজালেম শহর। জেরুজালেমের ইহুদী মন্দির ও পশ্চিম দেওয়াল বিখ্যাত। এছাড়া আছে যিশুখ্রিস্টের জন্মস্থান বেথেলহেম, বাসস্থান নাজারেথ। এখানে হারাম আল শরীফ তথা আল-আকসা মসজিদ অবস্থিত। ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ যা মুসলিমদের প্রথম কিবলা হিসাবে পরিচিত। ভূমধ্যসাগরের তীর জুড়ে রয়েছে অনেক অবকাশ যাপন কেন্দ্র। আরও আছে লবণাক্ত মৃত সাগর, যার পানিতে ভেসে থাকা যায়। লোহিত সাগরের উপকূল এবং গ্যালিলির সাগরের উপকূলেও অনেক অবকাশ কেন্দ্র আছে।
প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইহুদিরা জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করলেও ফিলিস্তিন অঞ্চলের আশেপাশের আরব রাষ্ট্র জাতিসংঘের প্রস্তাব নাকোচ করে দেয়। এবং তারা ইসরাইলকে বিন্দু মাত্র জমি দিতে অস্বীকার করে। এবং ১৯৪৮ সালে মাত্র একদিন বয়সী রাষ্ট্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে মিশর, জর্ডান, সিরিয়া এবং ইরাক। তাদের সাথে পরবর্তীতে যোগ দেয় সৌদি আরব, মরক্কো, ইয়েমেন এবং সুদান। ইসরাইলবাসীদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘা তখনো শুকায় নি। হিটলারের কৃতকর্মও তারা ভুলে যায় নি। তাই তারা জানতো তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এবার যদি তারা প্রাণপন লড়ে না যায় তাহলে দুনিয়া থেকে ইহুদি সম্প্রদায়ই মুছে যাবে। আর তাই তারাও তাদের সমগ্র শক্তি দিয়ে লড়ে যায়। পরের ঘটনা যে কাউকেই আশ্চর্য করে দিতে বাধ্য। মাত্রই জন্ম নেয়া একটা দেশ একই সাথে আটটা দেশের বিরুদ্ধে লড়েও যুদ্ধে জয়ী হয়ে যায়। প্রায় এক বছরব্যাপি চলে বন্ধ হয় এই যুদ্ধের। ইসরাইলের এই যুদ্ধে তেমন কোন ক্ষতি না হলেও মূল ক্ষতি হয় ফিলিস্তিনের। যুদ্ধের পর দেখা গেল ফিলিস্তিন বলে যে দেশটা হবার কথা ছিল সেটা ছিল দুটো অঞ্চল নিয়ে। একটা গাজা স্ট্রিপ অন্যটা পশ্চিম তীর। যুদ্ধের পর দেখা যায় গাজা স্ট্রিপের দখলদারিত্ব এবার মিশরের হাতে আর পশ্চিম দখল করে রেখেছে জর্ডান। যার মানে দাঁড়ায় ফিলিস্তিনের আর কোন দেশই বাকি থাকে না। নিজেদের মাটি মিশর আর জর্ডানের কাছে হারিয়ে প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনিদের সেবার বিভিন্ন আরব দেশে শরনার্থী হতে হয়েছিল।
১৯৬৭ সালে আবারো ইসরাইল এবং আশেপাশের বাকি আরব দেশগুলোর সাথে যুদ্ধ বাঁধে। যা দ্বিতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ নামেই পরিচিত। মাত্র ছয়দিন ব্যাপি এই যুদ্ধে মিশর, জর্ডান, সিরিয়ার জন্য এক লজ্জারই নাম বলা যায়। কারণ এই যুদ্ধেও ইসরাইলের জয় এবং আরবদের হার হয়। শুধু হারই না এবার ইসরাইল মিশরের কাছে থাকা গাজা স্ট্রিপ এবং জর্ডানের কাছে থাকা পশ্চিম তীর দখল করে নেয়। শুধু তাই না ইসরাইল এই যুদ্ধে মিশরের কাছ থেকে শুধু গাজা স্ট্রিপ না মিশরের নিজস্ব ভূমি সিনাই পেনিনসুলাও দখল করে নেয় এবং সিরিয়া থেকে দখল করে সিরিয়ার গোলান হাইটস। ১৯৬৭ সাল থেকেই ইসরাইল ফিলিস্তিনের ভূমি গাজা স্ট্রিপ এবং পশ্চিম তীর দখল করে রাখে। এই দখলের সময় যত বাড়ছিল ততই ইসরাইল বাসী জেরুজালেমের নিকটবর্তী বলে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক ভাবে এই বসতি স্থাপনকে অবৈধ বলা হলেও ইসরাইল সরকার এইসব বসতি স্থাপন বা সেটেলমেন্টে নিজেদের হস্তক্ষেপ নেই বলে বারবার বলতে থাকে। যদিও এতে ইসরাইল সরকারের হাত ছিলই। পশ্চিম তীর অঞ্চলের জমির দামও ছিল তুলনামূলক সস্তা যা এই বসতি স্থাপনের অন্যতম এরো একটি কারণ। তাই ধর্মপ্রাণ ধনী ইহুদিদের জন্য এটা লুফে নেওয়ার মতই ব্যাপার ছিল।
কথায় আছে “রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়”। ফিলিস্তিনিদের অবস্থাও ঠিক এমনই ছিল। আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মারা পড়েছিল মূলত ফিলিস্তিনিরাই। তাদের ভূমি একবার এর হাতে যায় তো একবার ওর হাতে। তাদের হাতে আর আসে না। আর এই থেকেই ১৯৬৪ সালে জন্ম হয় “ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন”। যাকে ছোট করে বলা হয় পি.এল.ও। পি.এল.ও শুরুতে অস্ত্র দিয়ে সবকিছু জয় করতে চাওয়ায় এবং ইসরাইলকে অস্বীকার করে তাদের থেকে ভূমি কেড়ে নিতে চাওয়াতে শুরতে তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন বলা হত। আস্তে আস্তে তারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ থেকে সরে আসলে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেয়। এবং তাদের ফিলিস্তিনবাসীদের অভিভাবক হিসেবে গন্য করে।
১৯৭৭-৭৮ সালে ইসরাইল এবং মিশরের মধ্যে কয়েক দফায় শান্তি বৈঠক চলে এবং শেষ পর্যন্ত এই বৈঠক সফল হয়। মিশর প্রথম আরব দেশ যারা ইসরাইলকে রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়। এবং ইসরাইলও প্রায় দশ বছর ধরে দখল করে রাখা মিশরের সিনাই পেনিনসুলা মিশরকে ফিরিয়ে দেয়। এই শান্তি বৈঠকের কারণে ১৮৭৮ সালে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মেনাশ্যাম বেগিম এবং মিশরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতকে নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। ইসরাইলের সাথে করা এই শান্তি বৈঠক আনোয়ার সাদাতের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ইসরাইলকে মেনে নেয়ায় এবং শান্তি চুক্তি করায় তার বিরুদ্ধে উগ্রবাদীরা দাঁড়িয়ে যায়। এবং ১৯৮১ সালে সেনাবাহিনীর কিছু উগ্রবাদী সদস্য তাকে হত্যা করে।
১৯৯২ সালে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হন ইৎসাক রাবিন। যে কিনা সরাসরি পি.এল.ও কে স্বীকার করে নেয়। নিজের বক্তব্যে তিনি বলে পিএলও কোন সন্ত্রাসী সংগঠন নয়। তারা শুধু নিজেদের দেশ চায়। এবং এর ফলস্বরূপ ইৎসাক রাবিন এবং পি. এল. ও প্রধান ইয়াসির আরাফাতের মধ্যে শান্তি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকের পর থেকে ফিলিস্তিন অলমোস্ট নিজেদের আলাদা দেশ তৈরির দ্বারপ্রান্তে চলে আসে। জাতিসংঘের প্রস্তাবনা অনুযায়ী গাজা স্ট্রিপ ও পশ্চিম তীর ফিলিস্তিনের হলেও তখন এসে দেখা যায় যুদ্ধের দামামায় ফিলিস্তিনিরা খুবই ছোট ছোট হয়ে একেক জায়গায় বাস করছে। এবং অনেক বেশি ইসরাইলি বসতি স্থাপনও হয়ে গেছে সেখানে। আর তাই পশ্চিম তীরে সেবার তিন ভাগে ভাগ করা হয় এরিয়া এ, বি ও সি নামে। যেখানে এরিয়া সি এর ক্ষমতা থাকবে পি. এল. ও এর হাতে, এরিয়া সি এর ক্ষমতা ইসরাইলের হাতে। এবং এরিয়া বি ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন দুই দেশ মিলে পরিচালিত হবে। আর এই একোর্ড মোতাবেক ১৯৯৪ সালে ফিলিস্তিনে প্রথম ফিলিস্তিনি সরকার গঠিত হয় যার নাম দেওয়া হয় ‘প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথোরিটি’। এই শান্তি আলোচনার কারনেও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এবং পি. এল. ও প্রধান ইয়াসির আরাফাত দুজন শান্তিতে নোবেল পান।
এদিকে ১৯৮৭ সালে কিছু কট্টরবাদী ফিলিস্তিনি নেতা পি. এল. ও কে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ আখ্যা দিয়ে নিজেদের আলাদা এক দল তৈরি করে এবং যার নাম দেওয়া হয় হামাস। হামাসের আদর্শ সেই প্রথম দিকের পি. এল. ও-র মতই। এরা ইসরাইলকে অস্বীকার করে এবং তাদের এই ভূমি থেকে চিরতরে মিটিয়ে দিতে চায়। একদিকে হামাসের করা পি. এল. ও’র বিরোধিতা অন্যদিকে ইসরাইলেও রাবিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে কট্টরবাদীরা। ইসরাইলি কট্টরবাদীরা বলে “ছোট জমি কেন, এক ফোটা জমিও দেওয়া যাবে না ফিলিস্তিনিদের” আবার হামাস প্রশ্ন তোলে, “কেমন করে পি.এল.ও ইহুদিদের সাথে হাত মেলায়”। ইসরাইলে কট্টরবাদীদের এই বিক্ষোভের মাঝেই ১৯৯৫ সালে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে ইসরাইলি এক কট্টরবাদী হত্যা করে প্রধানমন্ত্রী ইৎসাক রাবিনকে। আবার এদিকে হামাস ১৯৯৬ সালের নির্বাচন বয়কট করে এবং ইসরাইলের বিভিন্ন স্থানে সুইসাইড বোম্বিং করে। উল্লিখিত সাফল্যগুলো সবার নজর কাড়ে।
সম্ভাবনা
আমি বলবো ইসরাইল একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রায় ১০০ বছর ধরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে দেখা যায় তারা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সম্ভাবনা রয়েছে। ধীরে ধীরে তারা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণতও হচ্ছে। এতে করে তারা যদি আর্দশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নীতিগুলো অধ্যয়ন করে। যুদ্ধনীতি পরিহার, কতৃত্ববাদী নীতি পরিহার, ন্যাবিচার প্রতিষ্ঠা করা, সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি বিষয়গুলো মনে রাখা। যুদ্ধ কখনও সফলতা আনে না। যুদ্ধ মানুষকে ধ্বংস করে। এতে দু দেশের মানুষের জানমালের ক্ষতি হয়। আরবীতে একটি কথা আছে—“পাপের চেয়ে যখন অজুহাত অধিকতর কুৎসিত হয়ে ওঠে” তেমন অবস্থা যেনো না হয়। ইসরাইল যে কৌশলে গাজায় হামলা চালাচ্ছে, সেটি অবশ্য আন্তজাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। সাধারণ গাজাবাসীকে বিদ্যুৎ, পানি, খাবার, জরুরি ওষধ পাওয়ার সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে। হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা, স্কুল, শরণার্থী শিবিরের মতো জায়গায় বোমা ফেলা হচ্ছে। এটিকে বলা হয় জেনেভা কনভেনশন ও এর সর্ম্পূক প্রটোকলগুলো সর্ম্পূণ বিরোধী। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লীগ আলাদা আলাদা বিবৃতি প্রকাশ করে ইহুদিবাদী ইসরাইলের নয়া বসতি নির্মাণ পরিকল্পনার নিন্দা জানিয়েছে। গাজায় ইসরাইলের এ অসম হামলা নিঃসন্দেহে যুদ্ধাপরাধ ছাড়া আর কিছু নয় এবং ইতিহাস এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতি বিশ্বজুড়ে কতৃত্ববাদী সরকারের উত্থান ঘটাচ্ছে। (প্রথম আলো, ১৮ নভেম্বর ২০২৩) ইসরাইল দেখেছে তারা আজ স্বাধীন রাষ্ট্র কীভাবে পেয়েছে। তারা যদি শান্তির্পূণভাবে দেশ পরিচালনা করে তবে তাদের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। আর যদি তারা এসব হামলা করেই যায়। তাহলে তাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম আছে।
১০০ বছর ধরে এভাবেই ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আবার ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে পি. এল. ও এবং হামাসের মধ্যেও উত্তেজনা দিনদিন বাড়ছে। এর মাঝেই ২০০৬ সালের ফিলিস্তিন নির্বাচনে খুবই অল্প ব্যবধানে জিতে যায় হামাস। যা দুই দলের উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়। গাজা অঞ্চলে হামাসের সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাওয়া যায়, আর পশ্চিম তীর পি. এল. ও। নির্বাচনে জয়লাভের পর এই উত্তেজনার মাঝে এক বিশাল বড় বিল্ডিং এর ছাদ থেকে পি. এল. ও এর এক নেতাকে হামাসের কিছু কট্টরবাদী ফেলে হত্যা করলে শুরু হয় হামাস এবং পি. এল. ও এর গৃহযুদ্ধ। ২০০৭ সালের জুনের ১০-১৫ তারিখ পর্যন্ত চলমান এই গৃহযুদ্ধই ব্যাটেল অফ গাজা নামে পরিচিত। আর সেই থেকেই গাজা স্ট্রিপ হামাসের দখল দারিত্বে এবং পশ্চিম তীর অঞ্চল পি.এল.ও এর কন্ট্রোলে। আর তাই আমরা যখনই ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন সম্পর্কিত কোন খবর দেখি সেখানে গাজা নামটা খুবই কমন থাকে। এবং যেসব মিসাইল ছোড়ার খবর দেখি সবই গাজা থেকেই। অপরদিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হলেও পশ্চিম তীর অঞ্চল অনেকটাই শান্তিপূর্ণ এবং নিজেদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। অপর দিকে রক্তের নেশায় বুদ হয়ে থাকা দিনদিন তলিয়ে যাচ্ছে গাজা। প্রতিবেশি দুই দেশ মিশর এবং ইসরাইল দুই দেশের নিষেধাজ্ঞার চাপে পিস্ট হতে হতে গাজার পার ক্যাপিটা ইনকাম বর্তমানে এসে দাড়িয়েছে ১০০ ডলারেরও নিচে। একমাত্র এয়ারপোর্ট যেটা আছে সেটাও ব্যবহারের অযোগ্য। মাত্র পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চলা গাজা। সেগুলো আজ সব বন্ধ। কারণ তরুণ সকলেই যে যুদ্ধে ব্যস্ত গত দশ বছরে স্কুল বেড়েছে যার মাত্র ১০০ টির মত। যদিও সঠিক ভাবে পরিচালিত হয় না সেগুলোও। এই হল ফিলিস্তিন আর ইসরাইলের গত প্রায় ১০০ বছরের রক্তাক্ত ইতিহাস। যেভাবে যাচ্ছে সবকিছু তাতে করে আগামী একশ বছরেও এই রক্তের নেশা থামবে বলে মনে হয় না। একদিকে ইসরাইল যেমন পশ্চিম তীর অঞ্চলে কলোনাইজেশনের দোষে দুষ্ট, তেমনি অপরদিকে গাজা অঞ্চলে হামাস তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের দোষে। হামাস যতদিন গাজা দখল করে রাখবে আর ইসরাইলকে স্বীকৃতি না দেবে আর ইসরাইলের প্রতি অনমনীয় থাকবে ততদিন পর্যন্ত এই সংঘর্ষ থেকে মুক্তির কোন আশাই নেই। এখন পর্যন্ত যা দেখা যায় তাতে তো মনে করা হয় গাজা পুরোপুরি বিলীন হবে নয়তো ইসরাইল। তার আগ পর্যন্ত মুক্তি নেই এই ধ্বংসলীলা থেকে। আর জাতিসংঘের ফিলিস্তিন ও ইসরাইল বাটোয়ারা? ইসরাইল এতটাই বসতি স্থাপন করেছে পশ্চিম তীরে তাই ওটা থাকুক ইতিহাসের পাতায় আর সাধারণ ফিলিস্তিনিদের স্বপ্নেই।
ফিলিস্তিনি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার ইসরাইলি প্রকল্প কতটুকু সফল হয় তা মহান আল্লাহ ভালো জানেন। তবে ইসরাইলি র্ববরতায় আর ও অনারব জনগণের মধ্যে হামাসের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। আরবসহ গোটা বিশ্বে ফিলিস্তিনের জনগণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বোমার আঘাতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাদের স্বপ্নের মৃত্যু হবে না। আগামী দিনে ইসরাইল যদি শান্তিপূর্ণভাবে এই র্ববরতা দূর না করে তবে তাদের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসবে। আগামী দিনে ইসরাইলের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তথ্যঋণ : সমকাল পত্রিকা, উইকিপিডিয়া, অনলাইন র্জানাল, অনলাইন পত্রিকা, প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রেরক:
তারিকুল আমিন,
প্রাবন্ধিক, গল্পকার, আবৃত্তি ও অভিনেতা।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved
প্রযুক্তি সহায়তায়: বাংলাদেশ হোস্টিং